Saturday, September 20, 2014

প্রেমপত্র

আজকে আবারও লিখব কবিতা।
কারোর কথায় থামতে চাই না,
এমনকি তোমার কথাতেও না।
মনটা হয়েছে বড়ই অশান্ত; তুমি
যদি থাকতে কাছে, একটুখানি
স্নেহস্পর্শের হত সঙ্গলাভ,
দুটি-একটি ভালো কথার মধ্যেই
মন হয়ে উঠত উজ্জ্বল, লাভ করত
অমৃতের সুনিশ্চিত আস্বাদ। বিশ্বাস কর,
তোমাকে ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। তোমার
অতীত-বর্তমানকে বিস্মৃত হয়ে চেষ্টা করেছিলাম
তোমার অন্তরের সত্তার প্রেমে পড়তে। হয়তো
ব্যর্থ হয়েছে আমার সে প্রয়াস। হয়তো আমাকে
বিশ্বাস করতে পারোনি তুমি। তবু বলে যাই, আমি
তোমাকে এখনো ভালোই বাসি। তোমার জন্যে
ছাড়তে রাজি ছিলাম অনেক কিছু, ছেড়ে দিয়েওছি
কিছু কিছু। তুমি চিরকালই আমার মন-বাসার একটা ঘর
অধিকার করে থাকবে। সে ঘরে আর কারোর ঢোকার
অনুমতি নেই। এবারে আসি, রাত অনেক হল, চাঁদ ডুবে
গেছে পশ্চিমে, মেঘে ঢাকা আকাশ, হয়তো আসবে বৃষ্টি
কিছুক্ষণের মধ্যেই। ভালো থেকো সুরঙ্গমা।

অবতরণিকা

কি লিখব ভেবে পাই না মাঝে মাঝেই। তাই লিখি কবিতা।
কষ্টের কথা বলতে পারি না কাউকে, শোনার লোক কই?
লেখা আমার মন্দ নয়, তবে লিখতে গেলে গায়ে জ্বর আসে।
কি করি, নেহাত নাচার মানুষ, লিখি তাই ছোট ছোট কবিতা।
অনেক সময় মন থেকে বেরোয় সনেট, চোদ্দ লাইনে বাঁধা, আবার
অনেক সময় ঠিক চোদ্দটা লাইন লিখেই মন ভরে না, আরো লিখতে
ইচ্ছে হয় - লিখি বসে বসে। যতক্ষণ মন শান্ত না হচ্ছে। কবিতার আকার বেড়ে
ওঠে, লাইনগুলো ক্রমশই যেন বড্ড বেশী লম্বা হয়ে পড়ে, আর লাইনের
সংখ্যাও বেড়েই চলে ক্রমে ক্রমে। তবে একটা কথা ঠিক, লিখে মনটা
বেশ ভালো থাকে - সে কেউ পড়ুক চাই না পড়ুক। আর না পড়লেই বা কি?
না পড়লেই বরং ভালো। হয়তো কোথাও বানানে হয়েছে ভুল, হয়তো বা
ব্যাকরণ-দোষে পংক্তিনিচয় দুষ্ট, হয়তো অর্থের অপব্যবহারে শব্দ-সময় ক্লিন্ন।
কিন্তু এত ভাবতে চাই না, ভাবতে পারছিও না, পারবও না। হোক যা হবার।
যার পড়ার ইচ্ছে সে পড়ুক, আর যার ইচ্ছে নেই, সে বাড়ী গিয়ে ঘুমোক খানিক।

উত্তরাধিকার

আজকে লিখব শুধু কবিতা; ভালো লাগছে না অন্য কিছু করতে।
আজকে আঁকব শুধু ছবিটা; লাগছে না ভালো রান্নাবান্না করতে।
বাসন মাজা আর ঘর মোছা তো অনেক হল, আর কত? এবার
থামাও ভাই। এসো তার চেয়ে বরং লাল-নীল কবিতা বানাই
অনেকগুলো। বসে বসে গাঁথি মালা, সাজিয়ে কথার পরে কথা,
যে কথার কোন ভাষা নেই, কোন রূপ নেই, রস নেই, গন্ধ নেই, সেই
অদ্ভুত কথার মালা গাঁথি বসে চলো। সভ্যতার ঘানি টেনে টেনে মন
হল বিবশ বেরং। চলো না, আজ কিছুক্ষণের জন্যই না হয় রাঙিয়ে
তুলি তাকে। ছন্দ চাই না, ভাব হলেই চলবে। মনের মিলই যে আসল।
তুমি বল, আমি লিখি। খানিক না হয় তাকাই তোমার মুখের পানে।
তোমার বয়স হল অনেক, চোখের কোলে দীর্ঘ ভাঁজ, কপালে বলিরেখা,
দৃষ্টির ক্ষীয়মাণতা বে-আব্রু। তুমি বল তোমার মনের কথা, তোমার
জীবনের কাহিনী। আমি লিখব, আমি লিখতে চাই। অনেক কিছু করে
দেখলুম নেই লাভ কোন কিছুতেই। তাই এসেছি আজ তোমার কাছেই
সব কিছু ছেড়ে। হে বৃদ্ধ প্রপিতামহ, নেবে আমাকে তোমার সঙ্গী করে?

স্মরণবেদনা

আবার এসেছে যন্ত্রণা, ফিরে এসেছে;
নির্লজ্জ, বিকৃত স্বরে করেছে ঘোষণা
তার নিষ্ঠুর, নিষ্করুণ আগমনবার্তা।
একাকীত্বের দুঃসহ বেদনার মৈনাকচূড়ে
অসহনীয় দুঃখের শিকল পিষে বেরিয়ে
এসেছে সে। মারো, তাকে মেরে ফেলো।
চতুর্দিকে শুনতে পাচ্ছি "মার মার কাট কাট"।
মনের মধ্যে বন্ধ হোক এবার কাপুরুষ কপাট।
অন্ধ ধুলোর আকাশভাঙা ঝড়বৃষ্টিতে কোন কিছু
চোখে পড়ছে না ভালো করে, চশমার কাঁচে জলছিটে
লেগে দৃষ্টি হয়েছে ঝাপসা। অঝোর বৃষ্টি আর বজ্রগর্জনের
মুখরতায় মন আচ্ছন্ন বিহ্বল; মনে পড়ছে বহুদিন পূর্বের কথা,
বহু বহু দিন পূর্বের কথা। যে কথা কাউকে বলিনি, বলতে পারিনি,
আর কেউ শুনতেও চায়নি। এক চরম অসহায়তার অন্ধকারে তলিয়ে
যাওয়া এক বালকের কাহিনী। যে শুধু বাঁচতে চেয়েছিল। এমনকি চায়নি
সত্য, শিব, বা সুন্দরকেও। শুধু চেয়েছিল একটা স্বাভাবিক জীবন। ছোট ঘর
এক, সুখী পরিবার, দুটি ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখের সংসার - একটা শান্ত আঙ্গিনায়
তুলসীমঞ্চ। ভাগ্যের নিদারুণ পরিহাসে সে আজ উচ্চপ্রতিষ্ঠিত, ভবিষ্যত সুনিশ্চিত,
কিন্তু হারিয়ে গেছে বহুদিন আগের সেই স্বপ্নটা। সেই বাড়ী, সেই ঘরদোর, সেই কাঠকুটো,
সেই উনুনের ধোঁয়া আর কয়লার আঁচ।

Saturday, September 13, 2014

জাবালি

ঝুড়ি ভরে বয়ে আনি কাঠকুটো;
শীত আসছে, আগুনের সম্বল রাখা চাই তো।
দরিদ্র মানুষ আমি, ছোট ঘর, জানালায়
ছেঁড়াফাটা পর্দা, দরজার ওপারে একফালি
খোলা বারান্দা; আর তার পাশে ন্যাড়ামাথা
বুড়ো বটগাছে সারাদিন লেগে আছে
কাকেদের কোলাহল। রান্নাঘরে জমেছে
ঝুল-কালি, ঘর ঝাঁট দেওয়া হয়নি কতদিন।
দূরে পাহাড়চূড়োয় মেঘ করে এল, বৃষ্টি আসছে;
বইছে নদী কুলুকুলু-রবে উঠোনের একপাশ দিয়ে।
মনের মধ্যে মেঘ-রৌদ্রের আশা-নিরাশা খেলা।
অনেক দিন তার সঙ্গে কথা হয় নি,
সে কি এখন আমার কথা ভাবছে?
ঠিক এই মুহূর্তটিতে?

পুনর্লিখন

কবিদের ঘর বাঁধতে নেই।
খড়কুটো নিয়ে উড়ে গেছে কাক
নির্জন নির্মোহে;
মাঠের 'পরে উড়েছে ধুলো ঘূর্ণিপাকে,
দুপুর রোদে, দুঃসহ মৌনতায়।
শূন্য পথ, রৌদ্রদগ্ধ প্রান্তরে চলেছে
তাপতরঙ্গের অশান্ত আনাগোনা;
পথিক, তুমি কি হারিয়েছ পথ?
দিন কেটে গেছে কত এভাবেই,
কত অলস নীরবতায়, কত না-বলা কথায়,
কত অপ্রকাশিত ব্যথা-বেদনার নিঃসীম গহ্বরে।
এসেছে রাত্রি ধীরে, মাঠের ওপারে, উদয়সমুদ্রতীরে।
দিন আসে, দিন যায়।
কবিদের ঘর বাঁধতে নেই।

Wednesday, July 30, 2014

বন্ধুত্ব

মেয়ে, তোর জন্যে আজ আবার লিখছি কবিতা।
লেখা ভুলে গিয়েছিলাম, জাগিয়ে দিলি তুই।
অনেক কথা চাপা পড়েছিল নদীর বাঁকে বাঁকে,
ভাষার ফাঁকে ফাঁকে; ধুয়ে মুছে গেল সব আজ
বন্ধুত্বের চোরাস্রোতে। এই বন্ধুত্ব যেন বজায়
থাকে, কামনা করলুম অমিত্রাক্ষরে। ভেসে চলেছি
অজানার পথে, অচেনা আকাশের নীচে, অদেখা
স্রোতস্বিনীর ত্রিবেণীসঙ্গমে। কূল হারানোর অপার
আনন্দ-বেদনা বেজে চলেছে মনের বেণু-বীণে।
ভালো থাক তুই, এই কামনা করলুম সৃষ্টিকর্তা
হিরণ্যগর্ভের কাছে। দুঃখ-সুখের ছোটখাটো বেড়াগুলো
পার হয়ে যা অনায়াসে। মুক্ত হ', শুদ্ধ হ', জীবন তোর
ভরে উঠুক পরম পরিতৃপ্তিতে। শুভের সংস্পর্শে দূর হোক
অন্ধকার। গরলাধার রাত্রির শেষে বর্ষিত হোক
ত্বিষাম্পতির প্রভাতকিরণসুধা।

Thursday, July 17, 2014

অর্গল

চাইনা সহানুভূতি।
কোন দরকার নেই ভিক্ষান্নের, কাঁড়া কিম্বা আকাঁড়া।
যদি মনে করেন কৃপা করছেন, করছেন করুণা,
দয়া করে অন্য রাস্তা ধরুন, আপনার কৃপা চাইনা।
চাইনা মনোরমা ভার্যা, চাইনা রূপ-ধন-যশ-শত্রুতাপ,
চাই একটু সহমর্মিতা, একটুখানি পাশে থাকা,
দুটো চারটে ভালো কথা শুধু, হে মনোবৃত্ত্যনুসারিণি !
বন্ধু হও শুধু বান্ধবি, তোমার থেকে এর বেশি কিছুই চাওয়ার নেই
এই মন খারাপের শেষরাতে।
নিস্তব্ধ হয়ে গেছে রাস্তাঘাট,
এমনকি কুকুরগুলোও পড়েছে ঘুমিয়ে,
শ্বাপদেরা জেগে উঠেছে, খুঁজে চলেছে শিকার।
ভয় লাগছে আমার খুব, হাত ধরো তুমি,
চলো বসে থাকি ছাদে একলা হাওয়ায় যতক্ষণ সূর্য না উঠছে।

(Acknowledgement:  Closing sequence of the movie "Her" (2013) by Spike Jonze.)

যোজক

বুকের মধ্যে চেপে রাখি দুঃখ।
সকলে বলে, "রাখো চেপেচুপে"।
এদিকে দুঃখ ওঠে বেড়ে ক্রমাগত,
যন্ত্রণাকাতর পশু আছড়ায় হাত-পা।
বাড়তে বাড়তে শেষে ফেটে যায় ভিসুভিয়াস,
তখনো পারি না বলতে মুখ ফুটে।
সবাই বলে, "চেপে রাখো, রাখো চেপে,
"এই তো, আর কদিন, তার পরেই ভালো দিন আসছে,
"আসবে সত্যযুগ, সব দুঃখের হবে শেষ"।
কিন্তু সত্যি, আর কতদিন?
কেউ কি বলতে পারে?
মাঝে মাঝে বড় অসহ্য মনে হয়,
বড় অসহায় নিঃসঙ্গ মনে হয় নিজেকে, একলা লাগে খুব।
এর কি আদৌ কোন শেষ আছে? কে জানে?

অজানা

এখন কিছুই দেখার নেই, কিছুই করার নেই।
মন খারাপের বিকেল গড়িয়ে নেমেছে সন্ধ্যা অনেকক্ষণ,
শক্তি-হুমায়ুন-জীবনানন্দ-সুনীলের শায়রী শেষের পথে,
রবি ঠাকুর, তোমায় দিলাম এবারে ছুটি,
ঝলসানো চাঁদ ছিঁড়ে গেছে কুটিকুটি।
শহরের রাত, একলা পথের দুঃসহ নীরবতা,
ভুলতে না-পারা তোমার স্পর্শে ব্যথা,
বাইরে শেষ ট্রেনের আওয়াজ গিয়েছে থেমে।
দিবাহীন নিশি ধ্বস্ত প্রেমের নিষ্ফলতার গুনগুন।
বহমান এক বিপুল জনতা, সময়ের মাঝে টেনে চলা।
বন্ধুত্ব অনেক, অনেক কাজ, সময় বড়ই কম।
সবাই ব্যস্ত, সবাই একলা, সবাই অজানা সকলের।
কবিতার পাতে লিখে রাখি তার নাম।
এখন কিছুই দেখার নেই, কিছুই করার নেই।

Tuesday, March 4, 2014

চলো পালিয়ে যাই

ধূলিসাৎ জীবনের লিপিরেখা এঁকে চলে কবি,
বালি-কাঁকরে কেটে কেটে দাগ সে আঁকে ছবি।
লোকে বলে "পাগল, নিষ্কর্মা, উজবুক, ছোটলোক"।
কেউ কেউ অবজ্ঞাভরে দিয়ে যায় ছুঁড়ে চাহনি এক ঝলক।
অনেকে ঢিল মারে, কেউ দেয় থুতু, মাছি এসে উড়ে বসে জুড়ে।
পাড়ার ছেলের দল স্কুল-ফেরতা মুখ ভ্যাংচায় নাকিসুরে।
দিনের আলো পড়ে এলে আসে গার্ড, "এই, কৌন হ্যায়"!
দেখে সে টর্চের আলোয় পাগল অঘোর ঘুমায়।
লাথি মারতে মারতে তাকে নিয়ে চলে যায় অন্য চুলোয়,
যেখানে সে থাকবে আরো নিশ্চিন্তে, আরো নির্বিকার ধুলোয়।
অনেক দিন কেটে গেছে, কারোর নেই কোনো ক্ষোভ,
মলিন বিস্মৃত বিশীর্ণ জীবনের হারিয়েছে শেষ অভিযোগ,
লোকে চেয়ে চেয়ে দেখে হাসে কাঁদে গায় লাফায় এক পাগল,
সারা গায়ে জড়ানো রয়েছে তার ভারী ভারী লোহার শেকল।

(Acknowledgement:  Opening sequence of the movie "Grave of the Fireflies" by Isao Takahata)

যখন একদিন

কিছু কিছু ভালোবাসা না বলা থেকে যায়,
সন্ধ্যাকাশের রাঙা ধুলোর অধরা কুয়াশায়।
কিছু কিছু চেনাশোনা শেষ হয় অপরিচয়ে,
বেদনা শুধু থাকে জেগে অবাক বিস্ময়ে।
কাল চলে তার নিজের নিয়মে, মানে না কোন বাধা,
আশার জটিল গ্রন্থি থেকে থেকে মনে লাগায় ধাঁধা।
ফিরে ফিরে আসে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব অনাগতের বিকর্ষণে,
বুভুক্ষার নির্লজ্জ ব্যঙ্গ রূপকথা শোনায় কানে কানে।
ঝড়ে টলমল জাহাজ আছড়ে খোঁজে কূল,
উত্তাল নদীর পাড়ে যেমন এক গাছ ছিন্নমূল।
সব শেষ হয়েও পড়ে থাকে শব অসীম নগ্নতায়,
পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখা তাই একান্ত দুরাশায়।
সবাই বলে, "এগিয়ে চলো, সামনে দেখো, চেয়ো না ফিরে",
বসন্ত-পূর্ণিমার চাঁদ মুচকে হাসে আকাশজুড়ে।

(Alternative last line: বসন্ত-পূর্ণিমার চাঁদ ছড়ায় রূপো সমুদ্রতীরে।)