Monday, September 27, 2010

Tagore on juvenile mind by Kamalpriya Roy (Katy, TX)

রবীন্দ্র-সাহিত্যে শিশু ও কিশোর চরিত্র চিত্রায়ণের বৈশিষ্ট্য



কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহুমুখী রচনাশৈলীর মধ্যে ধ্বনিত হয়েছে কিশোর ও তরুণ প্রতিভার জয়। বালক ও কিশোরের সহজ প্রাণচাঞ্চল্য, তাদের সীমাহীন কৌতূহল কবি মনকেও করেছে আলোড়িত। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন গান ও কবিতায় তার প্রকাশ ঘটেছে সুন্দরভাবে।



মায়ের সঙ্গে শিশু ও বালক সন্তানের যে অপরূপ স্নেহময় বন্ধন পরিস্ফুট হয়েছে তাঁর বিভিন্ন কবিতায়। শিশু কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতা সত্যিই অদ্বিতীয়। যেমন - "লুকোচুরি" কবিতায় খোকার ভাবনায় খোকা হয়েছে চাঁপার ফুল। মার সব কাজই সে লক্ষ্য করছে চাঁপার ফুল হয়ে, আড়ালে থেকে; কিন্তু মাকে সে ধরা দিচ্ছে না। মার সঙ্গে লুকোচুরি খেলার যে অনাবিল আনন্দ তার অনুভবন কবিহৃদয়ের সঙ্গে পাঠকহৃদয়কেও আন্দোলিত করে। শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থের "মনে পড়া" কবিতাটিও অতি সুন্দর।



ছোট ছোট নানা ঘটনা যা আমরা তুচ্ছ মনে করি, বুঝলেও বোঝাতে পারি না, কবিগুরুর লেখনীতে সেইসব কথা ফুটে উঠেছে সুন্দরভাবে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে ছোট্ট মেয়েটির হাতের প্রদীপ নিভে যাওয়ায় যে অন্ধকারের সূচনা, আর তারই থেকে তার হারিয়ে যাবার যে দিশাহারা ডাক তা স্নেহদরদী পিতৃহৃদয়ের সঙ্গে ব্যাকুল করে তোলে প্রতিটি পাঠক পাঠিকার মন। (পলাতকা কাব্যগ্রন্থ, কবিতা - "হারিয়ে যাওয়া"।)



কিশোর মনের মধ্যে সুপ্ত কত কৌতূহল! কত ভালোবাসা! ছোট্ট গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে যে ছোট্ট নদী, তার বয়ে যাবার রূপটিই বা কি অপরূপ! রবীন্দ্রনাথ যেন এক বালকের ভাষাতেই সেই কথা বলেছেন - "আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাকে" কবিতায়।



এইভাবেই এগিয়ে যায় শিশুমনের কল্পনা। মেঘের রাজত্বে কারাই বা থাকে? তারা কেমনভাবে ঘোরে ফেরে? বেরিয়ে আসে মেঘ থেকে? একটি কবিতায় সোচ্চারিত হয়েছে সেই প্রশ্ন - "মেঘের মধ্যে মাগো যারা থাকে, তারা আমায় ডাকে।"



রবীন্দ্রনাথের আর একটি কবিতা "বীরপুরুষ" - কিশোর মনের একটি দিক, বীরত্বের ভাবটি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। কিশোরকালে সকল বালকেরই কল্পনায় থাকে একদিন সে বড় হবে, বীর হবে। রক্ষা করবে মাকে সকল বিপদের হাত থেকে। বীরপুরুষ কবিতায় তারই প্রতিচ্ছবি প্রতিছত্রে লিপিবদ্ধ হয়েছে।



কবি রবীন্দ্রনাথের মতো আর কোন কবিই বা বলতে পেরেছেন, ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন শিশু ও বালক মনের কথা?



কমলপ্রিয়া রায়

(প্রাক্তন ছাত্রী, শান্তিনিকেতন)

কেটি, টেক্সাস



লেখিকা পরিচিতি

বিশ্বভারতীর প্রাক্তন ছাত্রী কমলপ্রিয়া রায়ের বর্তমান ঠিকানা কেটি, টেক্সাস। শান্তিনিকেতনের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আশৈশব বেড়ে ওঠার প্রতিফলন তাঁর রবীন্দ্রচর্চায় ও সাহিত্যপ্রীতিতে।

Discussion on Meghdoot and Rabindranath by Dr Sukriti Lahiri (Vidyasagar College, Kolkata)

মেঘদূত, রবীন্দ্রনাথ, বর্তমান কাল এবং পাঠক



শিরোনামটি নানাভাবেই অসংগত বলে মনে হতে পারে কিন্তু সামান্য অনুধাবন করলেই বোঝা যাবে এই নামের প্রাসঙ্গিকতা। প্রকৃতপক্ষে মেঘদূত, রবীন্দ্রনাথ, বর্তমান কাল এবং সহৃদয় পাঠকবৃন্দ - এ সবই একই সূত্রে গ্রথিত। যদিও বাহ্যতঃ এঁরা প্রত্যেকেই ভিন্ন জাতীয় বলে চিহ্নিত, কিন্তু স্বরূপগত দিক দিয়ে কখনো এঁদের মধ্যে যে কোন ভেদই নেই তা আলোচনা করলেই বোঝা যাবে।



এবার আসি বিষয়ব্যাখ্যায়। কালিদাস কবে মেঘদূত লিখেছিলেন সে সম্‌বন্ধে আমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে, কিন্তু তাঁর কাব্যের বিষয়ের গভীরতা, অলংকারের ঐশ্বর্য, ভাষার মাধুর্য এবং সর্বোপরি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গী - এ সমস্ত কিছুই তাঁকে লোকোত্তর রসের স্রষ্টারূপে আমাদের সঙ্গে পরিচিত করিয়েছে। বহুযুগের ওপার থেকে কালিদাসের মেঘদূত - যা মন্দাক্রান্তা ছন্দে আবৃত্ত হয়ে আসে তা বর্তমানের পাঠকচিত্তে একই ভাবে নাড়া দিয়ে যায়, আলোড়ন তোলে। কিন্তু কেন এবং কিভাবে এই অসম্ভব সম্ভব হয়? এর উত্তর হল ঋষিকবি কালিদাস একদা মেঘদূতের ভাষায় যা বলে গেছেন, কোনদিন, কোন কালেই আর তার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবার নয়, কারণ তা হল সত্য এবং কালজয়ী। কালিদাসের মেঘদূতের আবেদন সর্বজনীন এবং সর্বকালীন। কালিদাস মেঘদূতের মধ্য দিয়ে যক্ষের বিরহব্যথা বা বর্ষার প্রকৃতিকেই শুধু সকলের বুকের কাছে নিয়ে আসেননি - মেঘদূত রচনার উদ্দেশ্য ছিল আরও অনেক, অনেক গভীরে। মেঘদূত প্রকৃতপক্ষে ধ্যানের মন্ত্র, কোন দার্শনিকের জীবন মন্থন করা আদর্শের প্রতিফলন। মেঘদূতে কালিদাস দেখিয়েছেন কেউ যদি যথার্থই সেই পরম লোকের আস্বাদ পেতে চায় তাহলে একদিন ঠিকই তার আকাঙ্খা পূর্ণ হয়। কিন্তু সেই আকাঙ্খাকে সফল করার জন্য তার যে সাধনা সে সাধনা বড় সহজ নয়। তাই সহজিয়া সাধনকে ত্যাগ করে কঠিন সাধনার পথ নির্বাচিত করে জীবকে এগিয়ে যেতে হয় এদেশ থেকে ওদেশ, ওদেশ থেকে সেদেশ। এইভাবে দেশ থেকে দেশান্তরে বিচিত্র মানবজীবনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে যেন ঈশ্বরের দূতরূপে মুক্তির পথ অন্বেষণ করে ফিরতে হয়। পথ কঠিন, জীবন বিচিত্র, কিন্তু পথিক পরাণ তারই জন্য অহর্নিশি এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরে চলেছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় - "কবে আমি বাহির হলেম তোমারি নাম গেয়ে, সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়"। সেই চলাই কালিদাসের রচনায় মেঘের চলা, বর্ষার মেঘের চলা। বর্ষার মেঘ সজল, সুনীল এবং গম্ভীর, কিন্তু তার দান অকৃপণ। তাই তার জলধারায় সিঞ্চিত হয় জগৎবাসী। তার করুণা থেকে বঞ্চিত হয়না কেউই। আবার সেও ঈশ্বরের প্রসাদরূপেই যেন ধরণীর বুকে ঝরে পড়ে। ঈশ্বরের করুণা, ঈশ্বরের অনুগ্রহ - এসবেরই প্রতিফলন বর্ষার আকাশে।



মেঘ পাহাড়, পর্বত ডিঙিয়ে পরম লোকের সন্ধানে যাত্রা করে কিন্তু পথের বাধা নানাভাবে নানা স্থানে তাকে আহত করে, ভগ্ন করে, প্রাচীরপ্রমাণ অবরোধ সৃষ্টি করে। তবু এইভাবেই বেড়া ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে একসময় সে এসে পৌঁছয় অলকা, যা তার একান্ত কামনার ধন। অলকাই হল মেঘের উত্তরণের দ্বার - পরম লোকের প্রবেশপথ। মানবজীবন অনন্তকাল ধরে এই অলকাকে পাওয়ার জন্যই উন্মুখ হয়ে থাকে। হয়তো কারো ক্ষেত্রে তা সচেতনভাবে, আবার কারো ক্ষেত্রে তা অচেতনভাবে। কারণ রবীন্দ্রনাথ যেভাবে অলকারূপ মোক্ষধামকে উপলব্ধি করেছেন, সকলেই সেভাবে তাকে চিনেছে একথা ভাবা ভুল। কিন্তু প্রত্যেক মানুষেরই অন্তরে জীবনব্যাপী সুপ্ত থাকে অলকার প্রতি গভীর আকাঙ্খা। পরোক্ষভাবে সেও তাই অলকারূপ মোক্ষধামের জন্য ব্যাকুল। কিন্তু সারাজীবন কঠোর সংগ্রাম না করলে অলকায় যে পৌঁছন কোনভাবেই সম্ভব নয়। সম্ভব নয় কোনভাবেই মেঘের উত্তরণ - এই উত্তরণের পথ যে বড় জটিল। পথের বাধা, শতসহস্র ঝড়-ঝঞ্ঝা সবকিছু অতিক্রম করলে তবেই সেই পরম প্রাপ্তি বা পরাপ্রাপ্তি। যে প্রাপ্তিতে চিত্ত হয় প্রশান্ত, ভাবরসে সমৃদ্ধ, আনন্দে উদ্বেল। কালিদাস যক্ষ এবং যক্ষপ্রিয়ার যে কাল্পনিক মিলনের চিত্র অঙ্কন করেছেন, তার মধ্যেও আছে মহামিলনের সুর, মহানন্দের বার্তা। আত্মোপলব্ধির থেকে এ আনন্দ এতটুকুও হীন নয়। তাই অলকাতে আছে ষড়্‌ঋতুর কুসুম, ষড়্‌ঋতুর আলো-বাতাস, ভ্রমরের গুঞ্জন। পৃথিবীতে কখনই একসঙ্গে সব ঋতুর স্পর্শ পাওয়া যায়না, একই সঙ্গে কুহু ও কেকার সঙ্গীতও শ্রুতিগোচর হয়না। মানুষ যে সব সময়ই তিথিডোরে বদ্ধ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় - "আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে"। সজল সঘন আষাঢ় মাসেও কবি ফাল্গুনের বাতাসের স্পর্শ পান বটে, কিন্তু তিথির বাঁধন তাঁর আকাঙ্খাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেনা।



কিন্তু অলকা সে যে উত্তরণের দ্বার। খুব কষ্ট করে হলেও সেখানে প্রবেশ করলে সবই মধুময় - শুধুই পাওয়া। কিন্তু এই পাওয়া মহাসাধনায়। তাই এর ফলও গভীর এবং মর্মস্পর্শী। জীবন কাটে অনন্ত আশা, অখণ্ড সত্যের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু দেহাতীত না হলে কি সেই তাকে ধরা যায়? সে যে পরম লক্ষ্যবস্তু, পরম ধামস্বরূপ। রবীন্দ্রনাথ তাই "মেঘদূত" কবিতায় বড় সুন্দরভাবে বলেছেন - "সশরীরে কোন্‌ নর গেছে সেইখানে, মানসসরসীতীরে বিরহশয়ানে, রবিহীন মণিদীপ্ত প্রদোষের দেশে, জগতের নদী গিরি সকলের শেষে"। মেঘ পেরেছিল সেই অসাধ্যসাধন করতে। কারণ সে যে দেহাতীত। কালিদাস মেঘের অলকা গমনের মধ্য দিয়ে দেহাতীতভাবে তাঁকে পাওয়ার সূক্ষ্ম ইঙ্গিত দিয়েছেন। কারণ দেহের বন্ধন এক পাহাড়প্রমাণ বাধা হয়ে দাঁড়ায় আত্মোপলব্ধির মুহূর্তে। নির্ভার, নিষ্কলুষ মেঘ কিন্তু অতি সহজেই অলকায় পৌঁছতে পারে। শরীর থেকেও শরীরাতীত বোধ জন্মায় মহামিলনকালে। যে মানব সেই অনুভূতিতে সমৃদ্ধ, কেবল সেই ব্যক্তিই অনায়াসে সর্বস্থানকে অলকারূপে দর্শন করতে পারে। তবে আত্মদর্শনের পূর্বে, অলকায় পৌঁছনর পূর্বে তার যাত্রার পথ হয় কঠিন থেকে কঠিনতর। কঠিনতার বেড়া অতিক্রম না করলে সেই পরম তীর্থে সে পৌঁছতে পারেনা। অতএব যক্ষের প্রেম অথবা যক্ষপ্রিয়ার প্রিয়মিলনের আকুতি - এ সমস্তই বাহ্য বিষয়। এ সমস্ত কিছুকে ছাপিয়ে মেঘদূতে যে জিনিসটি প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছে তা হল সেই পরমপুরুষকে পাওয়ার জন্য তীব্র যন্ত্রণা এবং নানাভাবে তাঁকে পাওয়ার পর অপার্থিব আনন্দ। সেই আনন্দ যে অপার এবং অভূতপূর্ব, তার অনুরণন মেঘদূতের উত্তরমেঘের ছত্রে ছত্রে লুকিয়ে আছে। মহাপ্রেমের মন্ত্র উত্তরমেঘের প্রতিটি পংক্তিতে। অলকা যথার্থই মোক্ষধাম - মহামিলনের প্রাঙ্গণ। কিন্তু সেই মিলনক্ষেত্রে পৌঁছতে গেলে বড় যন্ত্রণা, বড় বিঘ্ন। যক্ষ তাই মেঘকে তার সংবাদবাহকরূপে নির্বাচিত করেছে। পরিশেষে বলা যায়, যে মিলনের কল্পলোক সৃষ্টি করেছেন কালিদাস তা অনবদ্য এবং অনির্বচনীয়। যেমন শ্রীরামকৃষ্ণের মতে ব্রহ্ম অনির্বচনীয়, এঁটো হয় না, তেমনই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় - "এ রসে মিশাক তব নিঃশ্বাস, নবীন উষার পুষ্প-সুবাস"। যক্ষের সঙ্গে যক্ষপ্রিয়ার মিলনেই বিরহের অবলুপ্তি, অর্থাৎ ঈশ্বর-বিরহেরও অবলুপ্তি - এই কল্পনায় মিশে যায় সাংখ্যের পুরুষ ও প্রকৃতি।



ডঃ সুকৃতি লাহিড়ী

সংস্কৃত বিভাগ,

বিদ্যাসাগর কলেজ, কলকাতা।



লেখিকা পরিচিতি

বিশ্বভারতীর প্রাক্তন ছাত্রী ডঃ সুকৃতি লাহিড়ী বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজের সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপিকা। শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রপ্রভাবান্বিত ধ্যানগম্ভীর তরুচ্ছায়াতলে, দিগন্তাস্তীর্ণ প্রান্তরে ও স্নিগ্ধনিবিড় ঝুরিবটের পাতার ফাঁকে ফাঁকে অনুস্যূত সঙ্গীত ও সাহিত্যের বীজ আজ প্রকাশিত মহাবোধিরূপে।